18 May 2024, 05:45 pm

মৌলভীবাজারের এহসানুল কওমি মাদরাসায় পড়ে আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইঞ্জিনিয়ার

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : পড়ালেখা করেছেন কওমি মাদরাসায়। বর্তমানে চাকরি করছেন আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। তার নাম এহসানুল করিম হাসান।

এহসানুলের বাড়ি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায়। তার বাবা বিশিষ্ট আলেম হযরত মাওলানা আব্দুস সালাম মোহাদ্দিস। ছোটবেলা থেকে কওমি মাদরাসায় পড়ালেখা করেছেন তিনি। বর্তমানে চাকরির কারণে অবস্থান করছেন আমেরিকায়। কঠোর পরিশ্রম আর মনোবল তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

এহসানুল করিম হাসান মোবাইল ফোনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ১৯৮৯ সালে ভোগতেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হই। সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করি। তারপর ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সিলেটের ঐতিহ্যবাহী জামিয়া কাজিরবাজার মাদরাসায় ভর্তি হই। সেখানে ছুওম থেকে ছরফ পর্যন্ত পড়ি। সেখান থেকে চলে আসি মৌলভীবাজারের কওমি রায়পুর মাদরাসায়। সেখানে নাহবেমীর থেকে কাফিয়া পর্যন্ত পড়ি। ১৯৯৫ সালে আবারও চলে যাই জামিয়া কাজিরবাজার মাদরাসায়। শরহে জামী থেকে পড়ি সেখানে। এরপর ২০০১ সালে দাওরা হাদীস শেষ করি।

তিনি বলেন, আমার ইচ্ছে ছিল আমি একজন মাওলানা হব। মাওলানা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আমার প্রথম চাওয়া ছিল এবং এর পাশাপাশি বড় কিছু করা। কিন্তু আমি ও আমার পরিবারের সব সদস্য ২০০১ সালে আমেরিকা চলে আসি। এরপর থেকে এখানে বসবাস করছি। তারপর এখানে ২০০২ সালে অ্যাসোসিয়েট অব আর্টস এডুকেশন কোর্সে ভর্তি হই। ২০০৪ সালে ওয়াইন কাউন্টি কমিউনিটি কলেজ থেকে দুই বছর মেয়াদি কোর্সটি সম্পন্ন করি। তারপর ওয়াইন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও কম্পিউটার সাইন্স থেকে ৪ বছর মেয়াদী গ্রেজুয়েশন সম্পন্ন করি। ২০১৩ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সাইন্সে মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করি।

দেশে কিছু করতে চান কি-না এ প্রশ্নের জবাবে এহসানুল করিম হাসান বলেন, ইচ্ছে ছিল কিছু করার। কিন্তু সপরিবারে প্রবাসে চলে যাওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। তবে আমার শিক্ষকতা করার আগ্রহ বেশি ছিল। ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করি। বাংলাদেশে আমরা একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছি। এখান থেকে নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। যাতে তারা দেশের জন্য কাজ করতে পারে। দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে।

কওমি মাদরাসায় পড়ালেখা নিয়ে তিনি বলেন, কওমি হচ্ছে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা। আমি বলব কওমি মাদরাসার পড়ালেখার মান অনেক ভালো। এখানে আলাদা গাইড লাইন দিয়ে পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীদের এখানে পাঠ্য বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় পড়তে হয়। যে কারণে কওমি মাদরাসায় পড়া শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের সব বিষয় সম্পর্কে জানে।

এহসানুল বলেন, আমি যখন কওমিতে পড়ালেখা করি তখন কোনো সময়ই রোল ১০ এর ভেতরে থাকতে পারিনি। এখানে রোল নাম্বারে মার্কের খুব কম ব্যবধান থাকতো। তাই আমি বলি কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের থেকে মেধাবী। তাই আমি তাদেরকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখি।

তিনি আরও বলেন, কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা রুটিন মেনে পড়ালেখা করে। ফজরের আগে ঘুম থেকে উঠে তাদের নিয়মিত কার্যক্রম শুরু করে। সকাল ১০টার ভেতরে সকালের খাবার, গোসল শেষ করে ক্লাসের জন্য রেডি হয়। তারপর ক্লাস শেষ করে দুপুরের খাবার খায়। আছরের পর কেউ খেলাধুলা, কেউ লাইব্রেরিতে সময় ব্যয় করে। মাগরিবের পর থেকে পড়ালেখা শুরু করে। রাতের খাবার খেয়ে রাত ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে হয়। আর নিয়মিত রুটিন না মেনে চললে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয়।

কওমি মাদাসার ছাত্রদের ভবিষ্যত নিয়ে তিনি বলেন, আমি কওমি মাদরাসায় পড়েছি। আমি যেহেতু কওমি মাদরাসায় পড়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে পেরেছি তাহলে বাকি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। অবশ্যই কওমিতে পড়ালেখা করা শিক্ষার্থীরা অন্যদের তুলনায় এগিয়ে আছে এগিয়ে থাকবে এবং তাদের ভবিষ্যত উজ্জল।

তিনি বলেন, আমি কওমী মাদরাসার ছাত্র ছিলাম। এটা ঠিক আমাদেরকে ভিন্ন চোখে দেখা হত। আমাদের বলা হত আমরা ছাত্র হিসেবে সুবিধার নয়। আমাদের খুব একটা দাম দেওয়া হত না। কোন ধরণের পরীক্ষা ছাড়াই আমাদের হেয় করা হতো। মাদরাসার ছাত্র দেখে বিচার করা হত। অথচ মাদরাসার শিক্ষার্থীরা বেশি পড়ালেখা করে। তাদেরকে ৩টি ভাষায় পারদর্শী হতে হত। যারা এরকম করে তাদের এই কাজগুলো ভালো নয়। আপনি কোন ধরণের পরীক্ষা ছাড়া ঢালাও ভাবে এধরণের বিচার করতে পারেন না।

তিনি আরও বলেন, আমি যখন মাদরাসায় পড়তাম তখন বহুবার নিগ্রহের স্বীকার হয়েছি। তবে আমি দমে যাইনি। আমার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। যার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছি। এরপর সফল হয়েছি। এখন অনেকেই আমাকে দেখে তাদের ছেলে-মেয়েদের কওমি মাদরাসায় পাঠাচ্ছে পড়ালেখার জন্য। এটাই আমার সফলতা। মানুষ ধর্মের দিকে ঝুকছে। আমি বলব মাদরাসায় পড়ে যারা নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন তারা তাদের মনোবল আরও মজবুত করতে হবে। এবং সেই সাথে কঠিন পরিশ্রম করতে হবে।

আমেরিকার পেশাগত জীবন নিয়ে তিনি বলেন, আমেরিকায় যাবার পর প্রথমে কারের সিট বেল্ট তৈরি করে এরকম একটি কোম্পানিতে কাজ করি। এরপর ২০০৪ সালে এডুকেশন কোর্স করে চাকরি শুরু করি ডেট্টয়েট বোর্ড অব এডুকেশনের প্রোগ্রাম অ্যাডমিনিস্টেটর হিসেবে। সেখানে ৫৪টি স্কুলের বিভিন্ন অনুদান নিয়ে কাজ করতে হত। যা আসতো ফেডারেল এবং স্টেট গভর্মেন্ট এর কাছ থেকে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত সেখানে চাকরি করি। এরপর ২০১৪ সালে কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে গভীরভাবে কিছুদিন পড়াশুনা করি। একই বছরে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি শুরু করি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই চাকরি করি। ২০২০ সাল থেকে আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ পাই। বর্তমানে সেখানে কর্মরত আছি।

মাদরাসার ছাত্র হয়েও কিভাবে সেখানে সফল হলেন এই প্রশ্নের জবাবে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সফল হতে হলে প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম। আমি পরিশ্রম না করলে এ জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হত না। তাই সফল হতে হলে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। আর সফল হতে হলে পরিশ্রমের পাশাপাশি মনোবল রাখতে হবে। আমি পারব এই মানসিকতা রাখতে হবে।

কওমি শিক্ষা বোর্ডের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ও আল হাইতুল উলয়ার সদস্য মুসলেহ উদ্দিন বলেন, কওমি শিক্ষা কেবল ধর্মীয় শিক্ষাই নয়, এই শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সুস্থ চিন্তাধারার বিকাশ। তাই এহসানুল করিম হাসানের মতো হাজার হাজার শিক্ষার্থী দেশ-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। আমরা তার সফলতা কামনা করি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 4641
  • Total Visits: 744936
  • Total Visitors: 2
  • Total Countries: 1126

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ শনিবার, ১৮ই মে, ২০২৪ ইং
  • ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
  • ৯ই জ্বিলকদ, ১৪৪৫ হিজরী
  • এখন সময়, বিকাল ৫:৪৫

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
  12345
20212223242526
2728293031  
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018